সোমবার, ১৭ Jun ২০২৪, ০৪:১৬ পূর্বাহ্ন

বদলি হজ কী কেন এবং কিভাবে করবেন………?

বদলি হজ কী কেন এবং কিভাবে করবেন………?

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা ও মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ: ইবাদত ব্যক্তির ওপর আরোপিত আল্লাহর বিধান। যথাসময়ে যথানিয়মে সেই ইবাদত নিজেকেই পালন করতে হয়। কিন্তু কিছু ইবাদত পালনে স্থলাভিষিক্ত বানানো যায়। পবিত্র হজের বিধানের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অবকাশ রয়েছে। অক্ষমতার সময় নিজের হজ অন্যের মাধ্যমে করানো যায়। ইসলামের পরিভাষায় একে বদলি হজ বলা হয়।
হজ পালনে স্থলাভিষিক্ত বানানোর বৈধতা: সব ইবাদত তিন ধরনের ১. শারীরিক বা কায়িক ইবাদত; যেমনÑ নামাজ, রোজা ইত্যাদি। এগুলোর উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর আনুগত্যের মধ্যে থাকা। এই ইবাদতে সম্পদ ব্যবহƒত হয় না। ২. আর্থিক ইবাদত; যেমনÑজাকাত, সদকা ইত্যাদি। এর উদ্দেশ্য হলো অভাবগ্রস্তদের আর্থিক সাহায্য করা। আর ৩. ওই ইবাদতদ্বয়ের সমষ্টি হলো হজ। এতে তাওয়াফ-সায়ি ইত্যাদিতে রয়েছে বিনয় ও আনুগত্য, অন্য দিকে এতে আল্লাহর রাহে সম্পদ ব্যয় করতে হয়।
প্রথম ধরনের ইবাদতের মধ্যে (নামাজ, রোজা) অন্যকে ইবাদতের স্থলাভিষিক্ত বানানোর সুযোগ নেই; বরং প্রত্যেকে নিজেরটা পালন করতে হয়। কিন্তু দ্বিতীয় ধরনের ইবাদতে (আর্থিক ইবাদত) অন্যকে স্থলাভিষিক্ত বানানোর সুযোগ আছে। তাই সম্পদশালীদের জন্য তাদের জাকাত বা সদকা আদায় করার জন্য অন্য কাউকে স্থলাভিষিক্ত বানানো জায়েজ। তৃতীয় ধরনের ইবাদত হজ। এ ইবাদতেও স্থলাভিষিক্ত বানানোর সুযোগ আছে। তাই কেউ যদি হজ করতে অক্ষম হয়, তখন তার জন্য হজ পালনে কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত বানানো ওয়াজিব। (কিতাবুল ফিকহ : ১/১১৬৪, মুয়াল্লিমুল হুজ্জাজ : ২৮১)।
বদলি হজ শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি:-বদলি হজ শুদ্ধ হওয়ার কিছু শর্ত রয়েছে।
যথা:-বিনিময় দেওয়ার শর্ত না থাকা। ব্যয়ভার থাকবে প্রেরণকারীর দায়িত্বে। অবশ্য যদি বেশির ভাগ ব্যয় প্রেরণকারী বহন করে আর সামান্য কিছু ব্যয় পালনকারীও বহন করে, তবু জায়েজ আছে। মৃত ব্যক্তি বা যার পক্ষ থেকে হজ করানো হচ্ছে, তার মাতৃভূমি থেকে কেউ হজ করা উচিত। ইহরাম বাঁধার সময় হজের নিয়ত তার (হজ যার পক্ষ থেকে) পক্ষে হতে হবে; যেমনÑএরূপ বলবে যে আমি অমুক ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজের নিয়ত করছি। ইহরাম মিকাত থেকে বাঁধা উচিত, যদি প্রেরক ওমরাহ করার অনুমতি না দেয়, তাহলে মিকাত থেকে ওমরাহর ইহরাম বাঁধা যাবে না এবং হজে তামাত্তুও করা যাবে না। হ্যাঁ, যদি সে বলে দেয়, যেভাবে ইচ্ছা আমার হজ আদায় করে দেবে, তখন হজে তামাত্তুও জায়েজ হবে। বদলি হজ পালনকারী হজের সফরে যদি প্রেরকের টাকা আলাদা রাখে, নিজের টাকার সঙ্গে না মেশায়, তাহলে আমানত রক্ষা হবে; সতর্কতা সত্ত্বেও নষ্ট হলে জামিন হবে না। পক্ষান্তরে যদি সে নিজের টাকার সঙ্গে মিলিয়ে রাখে, তাহলে নষ্ট হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বদলি হজ পালনকারীকে যে টাকা দেওয়া হবে, তাতে খুব সতর্কতা আবশ্যক। অন্যথায় অন্যের হজ বিনষ্ট করার অপরাধে গুনাহগার হতে হবে। তাই সফর শেষে যে অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী (তাদের পয়সায় কেনা) অবশিষ্ট থাকবে, তা ফেরত দেবে। উত্তম পদ্ধতি হলো, প্রেরক প্রথমেই বলে দেবে, এক সফরে ব্যয় বিষয়ক কোনো অসংগতি হলে আমার পক্ষ থেকে মাফ। (ইমদাদুল আহকাম : ২/১৮৭; মুয়াল্লিমুল হুজ্জাজ : ১/২৮১)
যদি মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ যথেষ্ট হয় তাহলে যানবাহনে চড়ে হজ করতে হবে। আর যদি পুরো হজ হেঁটে করে, ভাড়ার টাকা সঞ্চয় করে রাখে, তাহলে জরিমানা দেওয়া ওয়াজিব। প্রেরক যদি পদব্রজে হজ করার অনুমতিও দেয় এবং মক্কা থেকে আরাফাতের ময়দানে যাওয়া-আসা যানবাহনে করা ওয়াজিব। আর বাকি সফরে প্রেরক অনুমতি দিলে পদব্রজে করাও জায়েজ আছে। (ইমদাদুল আহকাম : ২/১৮৭)
যদি জীবিত অক্ষম ব্যক্তির অনুমতি বা মৃত ব্যক্তির অসিয়তের কারণে বদলি হজ করানো হয়, তাহলে তার (প্রেরকের) মাতৃভূমি থেকে কাউকে দিয়ে হজ করানো আবশ্যক। এতে যদি মৃত ব্যক্তির এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ দিয়ে হজের ব্যয় যথেষ্ট না হয় এবং তার ওয়ারিশরাও অতিরিক্ত সম্পদ ব্যয়ে রাজি না হয়, তাহলে ওই টাকায় যেখান থেকে খরচ সংকুলান হয়, সেখান থেকে বদলি হজ করিয়ে দেবে। আর অসিয়তকারী যদি নিজে কোনো স্থান অথবা কিছু সম্পদ নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে তার কথা অনুসারে বদলি হজ করাতে হবে। তবে সামর্থ্যবান মানুষের জন্য এরূপ নির্ধারণ মাকরুহ। (আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৫২০; ফাতাওয়া রহিমিয়া ৫/২২৮; আহকামে হজ : ১২০)।
বদলি হজ কার পক্ষ থেকে করানো হবে: কোনো বক্তির ওপর হজ ফরজ হয়েছে, সে হজের সময়ও পেয়েছে, কিন্তু কোনো কারণবশত হজ করতে পারেনি; এরপর এমন ওজর বা প্রতিবন্ধকতা এসে গেল যে তার নিজে গিয়ে হজ করার ক্ষমতা আর রইল না অথবা এমন অসুস্থ হয়ে পড়ল, যা থেকে আর সুস্থ হওয়ার আশা নেই অথবা অন্ধ বা প্রতিবন্ধী হয়ে গেল বা বার্ধক্যের দরুন এমন দুর্বল হয়ে গেল যে এখন তার পক্ষে সফর করা সম্ভব নয়, তখন তার জন্য নিজের পক্ষ থেকে কাউকে পাঠিয়ে বদলি হজ করানো, অথবা মৃত্যুর পর তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে তার নামে বদলি হজ করানোর অসিয়ত করা ফরজ। বদলি হজের বিষয়ে ব্যাখ্যা হলো, যে সমস্যার কারণে বদলি হজ করানো হলো, ওই ওজর বা সমস্যা বদলি হজ করানোর পর দূর হয়ে গেলে আবার স্বয়ং তার হজ আদায় করা ফরজ হয়ে যাবে। আর আগের বদলি হজটি তার নফল হয়ে যাবে। (আহকামে হজ : ১১৮)।
রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে কি হজ পালন করা যাবে: নফল হজের সওয়াব রাসুল (সা.)-এর খিদমতে পেশ করা নিঃসন্দেহে জায়েজ, বরং বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। এতে রাসুল (সা.)-এর অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রকাশ পায়। আল্লামা শামী (রহ.) রদ্দুল মুহতারের মধ্যে আল্লামা ইবনে হাজর মক্কির উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন : হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পর রাসুলুল্লাহ (সা)-এর পক্ষ থেকে ওমরাহ পালন করতেন। (শামী বৈরুত সংস্করণ : ৩/১৪৩)।
বদলি হজ কে করতে পারবে: হানাফি মাজহাব অনুযায়ী যে ব্যক্তি এখনো নিজের হজ করেনি, সে-ও কারো পক্ষ থেকে বদলি হজ করতে পারবে, তবে মাকরুহ হবে। (আপকে মাসায়েল : ৪/৬৯)। যে ব্যক্তি এখনো নিজের হজ করেনি, তাকে হজে পাঠানো মাকরুহে তানজিহি অর্থাৎ অনুত্তম। তার পরও যদি হজে যায়, তাহলে বদলি হজ আদায় হয়ে যাবে। অতএব, এমন মানুষকে পাঠানো উচিত, যে একবার হজ করেছে। চাই সে ধনী হোক বা দরিদ্র। এ বিষয়ে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য নেই। (আপকে মাসায়েল: ৪/৭৬; ফাতাওয়া দারুল উলুম : ৬/৫৭৩; কিতাবুল ফিকহ : ১/১৩২২) কোনো নারীর পক্ষ থেকে বদলি হজ করাতে হলে অন্য নারী দিয়েই করাতে হবে এমন কোনো আবশ্যকতা নেই। বরং নারীর পক্ষ থেকে পুরুষও বদলি হজ করতে পারবে এবং পুরুষের পক্ষ থেকে নারীও হজ করতে পারবে। (আপকে মাসায়েল : ৪/৭৫) নাবালেগ (অপ্রাপ্তবয়স্ক) বদলি হজ করতে পারবে না। (আপকে মাসায়েল : ৪/৭৭) নারী ও দাসও বদলি হজ করতে পারবে। (কিতাবুল ফিকহ : ১/১১৬৬)।
বদলি হজ পালনকারী আর্থিক লোকসানের ক্ষতিপূরণ নিতে পারবে কি না: বদলি হজ পালনকারীর আর্থিক লোকসানের ক্ষতিপূরণ নেওয়া জায়েজ হবে না; কারণ তার যে আয় কম হয়েছে, এটা তার নিজের কষ্টার্জিত কোনো সম্পদ নয়, যার ক্ষতিপূরণ জায়েজ হয়। যদি এই বিনিময় কষ্ট ও পরিশ্রমের বিনিময়স্বরূপ হয়, তাহলে এটা হবে ইজারা বা মজদুরি। আর ইজারা বা মজদুরি হিসেবে বদলি হজ জায়েজ নেই। কোনো কোনো রায় মতে তা হজই হবে না। তবে গ্রহণযোগ্য মতে বিনিময় নিয়ে হজ করা ভুল। তবে হজ আদায় হয়ে যাবে। অবশ্য যদি প্রেরক স্বেচ্ছায় চুক্তি ও বিনিময় ছাড়া হজের খরচ হিসেবে কোনো টাকা-পয়সা দেয়, তবে তা জায়েজ হবে। তেমনি সফরকালীন পরিবারের ব্যয় খরচ প্রয়োজন হিসেবে চাইতে পারবে; বিনিময়স্বরূপ নয়। এ তো গেল জীবিত ব্যক্তির কথা। যদি মৃত ব্যক্তির অসিয়তের কারণে বদলি হজ করানো হয়, তাহলে হজের নিয়মিত খরচের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান তার বালেগ (প্রাপ্তবয়স্ক) ওয়ারিশরা নিজেদের অংশ থেকে দিতে পারবে। কিন্তু নাবালেগ (অপ্রাপ্তবয়স্ক) ওয়ারিশদের অংশ থেকে দেওয়া জায়েজ নেই। আর ওয়ারিশ যদি নাবালেগও থাকে, সে ক্ষেত্রে হজের প্রয়োজনীয় খরচে মৃতের এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে দেবে। আর কাবে (প্রেরিত ব্যক্তিকে) অতিরিক্ত সহযোগিতা বা পরিবারের ব্যয়স্বরূপ বালেগ ওয়ারিশরা নিজেদের পক্ষ থেকে দেবে। এ বিষয়ে এমন লোক খোঁজা উত্তম, যার কোনো পরিবারের ব্যয় নেই; শুধু হজের খরচ পেলেই সে হজে যেতে পারে। কিন্তু যদি পরিবার-পরিজনওয়ালা ছাড়া কাউকে নির্ভরযোগ্য, সঠিকভাবে হজ পালনকারী না পাওয়া যায়, তখন এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে তার পরিবারের ব্যয়ভারও বহন করা জায়েজ, বরং যদি মৃত ব্যক্তি অসিয়তও করে যায় এবং তার এক-তৃতীয়াংশ সম্পদে সামর্থ্যও থাকে তখন ওয়ারিশদের ওপর জরুরি হয়ে যাবে। (ইমদাদুল আহকাম : ২/১৯২)।
বদলি হজকারীকে সফরের খরচ কী পরিমাণ দিতে হবে: হজের খরচের বিষয়ে নির্ধারিত কোনো পরিমাণ নেই। ব্যয়বহুল সফর, মধ্যমব্যয়ী সফর বা সাধারণ সফর এই তিন ধরনের যেভাবেই সে (প্রেরিত ব্যক্তি) রাজি হয়, তা দিয়ে তাকে রাজি করাবে। (ফাতাওয়া দারুল উলুম : ৪/৫৬৯) বদলি হজ পালনকারীকে মক্কা পর্যন্ত যাওয়া-আসাসহ যাবতীয় খরচ প্রেরণকারীর সম্পদ থেকে দিতে হবে; অন্যথায় হজের ফরজ আদায় হবে না। হ্যাঁ, নফলের সওয়াব পাবে। আর যখন বদলি হজ পালনকারীকে টাকা দেওয়া হলো বদলি হজের জন্য, কিন্তু সে প্রেরকের পক্ষ থেকে হজ করল না, সে ক্ষেত্রে প্রেরণকারীর হজ হবে না, তাই গুনাহ হবে। প্রেরিত ব্যক্তির এবং কিয়ামতে তারই পাকড়াও হবে। (ফাতাওয়া দারুল উলুম : ৪/৫৬৭; আহকামে হজ : ১১৯)।
বদলি হজ পালনকারীর খরচ যথেষ্ট না হলে: বদলি হজ পালনকারীর যদি পথে খরচ শেষ হয়ে যায়, তখন সে নিজের ব্যক্তিগত টাকা বা কারো থেকে ঋণ করে আসে, তখন দেখতে হবে যে বেশি খরচ কার পক্ষ থেকে হয়েছে। যদি প্রেরণকারীর বেশি খরচ হয় তাহলে বদলি হজ আদায় হয়ে যাবে। আর যদি প্রেরিত ব্যক্তির বেশি খরচ হয়, তাহলে বদলি হজ শুদ্ধ হবে না, বরং পালনকারীর পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। বর্ণিত ফায়সালা তখন প্রযোজ্য হবে, যদি প্রেরণকারী কর্জ ইত্যাদি করে খরচ করার অনুমতি না দেয়। আর যদি তার অনুমতি দিয়ে বলে দেয় যে পথে খরচের সংকট দেখা দিলে তুমি কারো কাছ থেকে কর্জ ইত্যাদি করে সেরে নিয়ো, আমি তোমাকে দেশে ফিরলে তা পরিশোধ করে দেব, তাহলে বদলি হজ শুদ্ধ হবে। (রদ্দুল মুহতার : ১/৩৩৪; ইমদাদুল আহকাম : ২/১৮৮) বদলি হজ শেষ করার পর উদ্বৃত্ত অর্থ ফেরত দিতে হবে। হ্যাঁ, যদি প্রেরণকারী তাকে ওই অর্থ দান করা বা নিজে ব্যবহারের অনুমতি দেয়, তাহলে ব্যবহার জায়েজ হবে। (ফাতাওয়া দারুল উলুম : ৪/৫৭৩)।
বদলি হজ করলে নিজের ফরজ হজ আদায় হবে কি: কোনো গরিব মানুষ অন্যের বদলি হজ পালন করলে তার নিজের ফরজ আদায় হবে না, অর্থাৎ যদি কখনো সে বিত্তবান হয়ে যায় এবং হজ ফরজ হয়, তাহলে তাকে আবার নিজের ফরজ হজ আদায় করতে হবে। এ জন্য বদলি হজের নিয়ম হলো, এমন কাউকে পাঠানো, যে নিজের ফরজ হজ আদায় করেছে। বদলি হজ পালন করে কী লাভ? বদলি হজের সুবাদে হলেও মক্কা-মদিনার দোয়া কবুলের পবিত্র স্থানগুলোতে দোয়া কবুলের নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য নসিব হয়, এটা তো ঘরে বসে কোনো দিন সম্ভব নয়। আর অনেক ক্ষেত্রে বদলি হজ করার সওয়াব নিজের হজের চেয়ে বেশি হয়। (ইমদাদুল আহকাম : ২/১৯০)।
বদলি হজ করলে কি হজ ফরজ হয়ে যায়: বদলি হজ করলে হজ ফরজ হয় না। কারণ হজ ফরজ হওয়ার জন্য হজের ব্যয়ভার বহন করার সামর্থ্য থাকা আবশ্যক। তা ছাড়া হজ ফরজ হবে না। আর অনেকের ধারণা, বদলি হজের সুবাদে বায়তুল্লাহ দেখার কারণে তার ওপরও পরবর্তী বছর হজ ফরজ হয়ে যায়। এই ধারণা ভুল। বদলি হজের মধ্যে যিনি হজে পাঠাচ্ছেন তার পক্ষ থেকে নিয়ত হতে হবে; যেমনÑ হজ পালনকারী এমন নিয়ত করবে, আমি অমুক ব্যক্তির পক্ষ থেকে ইহরাম বাঁধছি এবং তালবিয়া পড়ছি। এই নিয়ত মনে মনে করাও যথেষ্ট। (কিতাবুল ফিকহ : ১/১১৬৫; আহকামে হজ : ১২০)। বদলি হজের মধ্যে প্রেরণকারীর নাম মুখে নেওয়া জরুরি নয়, বরং তার নিয়তই যথেষ্ট; যেমনÑ আমাকে যিনি হজে পাঠাচ্ছেন তার পক্ষ থেকে আমি ইহরাম বাঁধছি। আর যদি ভুলবশত ইহরামের সময় তার পক্ষ থেকে নিয়ত করা হয়নি, তাহলে বদলি হজ শুদ্ধ হবে না। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ১৭/২০০; মুয়াল্লিমুল হুজ্জাজ : ১২)।
দুই ব্যক্তির পক্ষ থেকে এক হজ: যদি কাউকে দুজন নিজ নিজ হজ পালন করতে পাঠায় এবং সে দুজনের পক্ষ থেকে ইহরাম বাঁধে, তাহলে কারো হজই হবে না। বরং সেই টাকা ফেরত দিতে হবে। (কিতাবুল ফিকহ : ১/১১৬৬)। বদলি হজ পালনকারী দ্বিনদার, নির্ভরযোগ্য মানুষ হওয়া চাই। অনেক লোক কয়েকজন থেকে টাকা নিয়ে বদলি হজ করে। এতে কারোই হজ আদায় হয় না। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৫২০)।
মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে বদলি হজ প্রসঙ্গে: যদি কোনো ব্যক্তির ওপর হজ ফরজ হয় এবং সে মৃত্যুর সময় এই পরিমাণ সম্পদ রেখে যায় যে তার এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ দিয়ে কাউকে হজে পাঠানো সম্ভব, উপরন্তু সে মৃত্যুর সময় বদলি হজ করানোর অসিয়তও করে গেল, এ অবস্থায় তার পক্ষ থেকে বদলি হজ করানো ওয়ারিশদের ওপর ফরজ। যার ওপর হজ ফরজ ছিল, সে যথেষ্ট সম্পদ রেখে যায়নি বা অসিয়তও করে যায়নি, তাহলে তার পক্ষ থেকে বদলি হজ করানো ওয়ারিশদের জন্য আবশ্যক নয়। কিন্তু যদি ওয়ারিশরা তার পক্ষ থেকে বদলি হজ করে নেয় অথবা কাউকে দিয়ে করায়, তবে আশা করা যায় আল্লাহ তায়ালার রহমতে মরহুমের হজের ফরজ আদায় হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তির ওপর হজ ফরজ নয়, তার পক্ষ থেকে যদি ওয়ারিশরা বদলি হজ করে বা করায়, তাহলে এটা নফল হজ হবে। মৃত ব্যক্তি অবশ্যই এর সওয়াব পাবে। (আপকে মাসায়েল : ৪/৬৯)। মা-বাবার ওপর হজ ফরজ ছিল না, কিন্তু সামর্থ্যবান ছেলে যদি মা-বাবার পক্ষ থেকে হজ পালন করে, তাহলে তা তাদের পক্ষ থেকে নফল হজ আদায় হবে। (আপকে মাসায়েল : ৪/৭৩; ফাতাওয়া রহিমিয়া : ৫/২১৫)। যার ওপর হজ ফরজ নয়, তার পক্ষ থেকে বদলি হজ করা যাবে। চাই জীবিত হোক বা মৃত। তবে এই হজ নফল হবে। যদি মা-বাবা গরিব হয়, তাদের ওপর হজ ফরজ নয়, এ অবস্থায় (সামর্থ্যবান) ছেলের ওপর তাদের পক্ষ থেকে বদলি হজ করানো আবশ্যক নয়। (ফাতাওয়া মাহমুদিয়া : ৩/১৮৭)। যদি মৃত ব্যক্তির ওপর হজ ফরজ থাকে আর তার পক্ষ থেকে কেউ হজ করতে চায়, তাহলে ইহরাম মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে বাঁধতে হবে। না হলে তার ফরজ হজ আদায় হবে না। (ফাতাওয়া দারুল উলুম : ৬/৫৭২)।
বদলি হজে টাকা কম হলে কী করবে: বদলি হজের বেলায় আবশ্যক হলো, প্রেরকের দেশ থেকে হজের সফর শুরু করা। কিন্তু অর্থ কম হওয়ার কারণে অন্য যে স্থান থেকে খরচ সংকুলান হয়, সেখান থেকে সফর শুরু করা জায়েজ। এ অবস্থায় যেকোনো রাস্তা, যেকোনো মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে পারবে। (ফাতাওয়া দারুল উলুম : ৬/৫৭০)।
বদলি হজে কোরবানির বিধান: বদলি হজকারী ইহরাম বাঁধবে হজে ইফরাদের। তাই তার ওপর কোনো কোরবানি ওয়াজিব নয়। এবং প্রেরকের পক্ষ থেকেও কোরবানির প্রয়োজন নেই। তবে যদি বদলি হজ পালনকারী স্থানীয় সামর্থ্যবান ধনী মানুষ হয়, তাহলে নিজের ব্যক্তিগত ওয়াজিব কোরবানি করতে হবে। আর অসমর্থ, গরিব মুসাফিরের ওপর সাধারণ কোরবানি ওয়াজিব নয়। আর যদি বদলি হজ পালনকারী তামাত্তু হজের অর্থাৎ মিকাত থেকে ওমরাহর ইহরাম বেঁধে মক্কা গিয়ে ওমরাহ শেষে ইহরাম খুলে ফেলে, এরপর ৮ জিলহজ আবার হজের ইহরাম বাঁধে, তাহলে তার নিজ খরচে কোরবানি করা ওয়াজিব; প্রেরকের খরচে নয়। হ্যাঁ, প্রেরক অনুমতি দিলে তার সম্পদ থেকে কোরবানি করা যাবে। (আপকে মাসায়েল : ৪/৭৮)। বর্তমানে আমাদের দেশে বদলি হজে প্রেরকের পক্ষ থেকে তামাত্তু ও কিরান এবং কোরবানির অনুমতি দেওয়া প্রচলিত হয়ে গেছে। তাই এখন স্পষ্টভাবে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তার পরও অনুমতি নেওয়া ভালো। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৫১৩)।
বদলি হজ পালনকারী ভুল করলে: বদলি হজ পালনকারী যদি এমন কোনো ভুল করে, যার দরুন হজ নষ্ট হয়ে যায় এবং সেটা যদি আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের আগেই প্রকাশ পায়, তাহলে হজ বাবদ সমুদয় ব্যয় করা অর্থ হজ পালনকারীর প্রেরককে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু যদি আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের পর প্রকাশ পায় বা ঘটে, তাহলে টাকা ফেরত দিতে হবে না। কারণ হজের প্রধান রুকন আরাফাতের অবস্থান, সেটা তো আদায় হয়ে গেছে। তবু ভুলের সব কাফফারা (মাসুল) পালনকারীকে দিতে হবে। কেননা এর কারণ সে নিজেই। তবে ইহসার (অবরুদ্ধ) হলে এর কোরবানি প্রেরকের দায়িত্বে থাকবে। কারণ তাতে পালনকারীর কোনো হাত নেই, বরং সে এ বিষয়ে নিরুপায়। (কিতাবুল ফিকহ : ১/১১৬৭)।
বদলি হজ পালনকারী পথে মারা গেলে: বদলি হজ পালনকারী পথে মারা গেলে অন্য কাউকে দিয়ে আবার কাউকে পাঠিয়ে হজ করাতে হবে। কিন্তু বদলি হজ পালনকারী (মৃত ব্যক্তি) যদি আরাফাতে অবস্থানের পর মারা যায়, তাহলে মৃত ব্যক্তির হজ আদায় হয়ে যাবে। (মুয়াল্লিমুল হুজ্জাজ : ২৯১)

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877